Breakingখাগড়াছড়িচট্টগ্রাম অঞ্চলপার্বত্য অঞ্চলবান্দরবানরাঙ্গামাটিশীর্ষ সংবাদসারাদেশ

নববর্ষকে বরণ করে নিতে পাহাড়ে নানা আয়োজন চলছে

চেঙ্গী দর্পন , স্টাফ রিপোর্টার, খাগড়াছড়ি : পুরাতন বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে সাজানো হচ্ছে চলছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি জুমঘর “মোনঘর” নির্মাণের কাজ । বাঙ্গালীদের নববর্ষ , ত্রিপুরাদের প্রধান সংস্কৃতির উৎসব বৈসু ,চাকমাদের ফুল বিজু ,মারমাদের সাংগ্রাই জলোৎসবের মধ্যে দিয়েই শুরু হবে বৈসাবি উৎসব। পাহাড়ের প্রতিটি গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে উৎসবের আমেজ। উৎসবকে আনন্দ ঘন ও অতিথিদের আপ্যায়ন করতে স্থানীয় বাজার গুলোতে কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পাড় করছে বাঙ্গালী – উপজাতীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর জনগন। মহামারী করোনায় পার্বত্য অঞ্চলে গত বছর পাহাড়ের বৈসাবী উৎসব তেমন ভাবে পালিত না হলেও এ বছর আনন্দৎসব যেন আরো দ্বিগুন বেড়ে গেছে।

বৈসাবিকে কেন্দ্র করে ফুটে ওঠে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। তাই এটি পাহাড়িদের সাংস্কৃতিক চেতনার উৎসস্থল সামাজিক সাম্যবাদের প্রতিফলন। পার্বত্য অঞ্চলের লোকজন বছরের শেষদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন পারস্পরিক সান্নিধ্য লাভ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষায় এ উৎসবের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হলেও উৎসবের লক্ষ্য ও রীতি প্রায় এক।

বৈসাবিতে পার্বত্য অঞ্চলের ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সকল ভেদাভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলার শপথ নেয়। চাকমা সম্প্রদায় এ উৎসবকে বলে ‘বিজু’ ত্রিপুরারা বলে ‘বৈসু’ আর মারমারা বলে সাংগ্রাই। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু মিলে সংক্ষেপে এই উৎসবটির নামকরণ করা হয়েছে বৈসাবি।

পানছড়ি উপজেলার প্রবিন রাজনীতিবিদ সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বকুল চন্দ্র চাকমা বলেন, আদিকাল থেকে পাহাড়িরা স্বীয় বৈশিষ্ট্যের বিজু সাংগ্রাই ও বৈসু পালন করে আসছে। চাকমাদের মতে বিজুতে সবার মনে বয়ে আনে অপরূপ সম্প্রীতি। জাতি,শ্রেণি, ধনী, গরীব শত্রু-মিত্রের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবাই যেন এই সামাজিক উৎসবকে নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। তাই বিজু বয়ে আনে সম্প্রীতি, নতুন চিন্তা-চেতনা। চাকমা সমাজে এটি একটি অত্যন্ত আনন্দঘন দিন।

১২ এপ্রিল ২০২২ ফুল বিজু , চৈত্র মাস শেষের দিনের আগের দিন চাকমরা পালন করা হয় ফুল বিজু, ত্রিপুরা পালন করে হারি বৈসু। উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ভোরে উঠে পাহাড়ের বিভিন্ন বাগান থেকে ফুল তুলে গঙ্গাদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে ফুল বিজুর সূচনা করা হয়। এছাড়াও বৌদ্ধবিহার, নদী বা খালে গিয়ে আগামী দিনের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য ভগবান বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করে। বিকেলে মোমবাতি এবং সাদা সুতা দিয়ে তৈরি বাতি সরিষার তৈল দিয়ে জ্বালিয়ে একই স্থানে প্রার্থনা করা হয়। ফুল দিয়ে ঘরে প্রতিটি দরজার মাঝখানে মালা গেঁথে সাজানো হয়।

১৩ এপ্রিল ২০২২ খ্রি. মূল বিজু , এই দিনটি বর্ষা বিদায়ী দিন বললেই চলে। ৩০ চৈত্র এই উৎসবটি পালিত হয়। বাঙ্গালীদের চৈত্র সংক্রান্তির দিন পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা সম্প্রদায় এ দিনকে মূল বিজু বলে থাকে। এ দিনে পাহাড়িদের ঘরে ঘরে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। যে খাবারটি প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় তা হলো অতি পরিচিত ‘পাচন’। বিভিন্ন সবজী ও ফল মুল দিয়ে সহকারে প্রায় শতাধিক পদ দিয়ে তরকারি দিয়ে রান্না করা হয়। এই দিনে প্রতিটি ঘরে ঘরে চলে অতিথিদের আপ্পায়ন। সু-স্বাধু পাঁচন, বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করা হয়। এছাড়া অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয় , নিজেদের তৈরি মদ দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয় অতিথিদের। এদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে ও স্নান সেরে নেয় সবাই। তারপর নতুন বা পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে সবাই ঘুরতে বের হয়। অনেক রাত পর্যন্ত চলে এই ঘোরাফেরা। এ সময় গান বাজনাও চলে।

১৪ এপ্রিল ২০২২ ১লা বৈশাখ গয্যাপয্যা বিজু। এই দিনটিকে পাহাড়ের গয্যা পয্যা দিন: বলে থাকে। এ দিনটি হলো মূল বিজুর পরের দিন। অর্থাৎ বাঙ্গালীরা ১ বৈশাখ পালন করে। এই দিনে ভালো ভালো খাবার তৈরি করে বয়োজ্যেষ্ঠদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। যাতে গুরুজনদের আশীর্বাদ পেয়ে আজীবন সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করা যায়।

৫ এপ্রিল ২ বৈশাখ পাহাড়ে প্রতিটি সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে চলে আনন্দ উৎসব।


১৬ এপ্রিল মারমাদের সাংগ্রাই উৎসবের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। মারমা তরুন তরুনীরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। উৎসব কি পাহাড়ীদের না বাঙ্গালীদের তা বোঝার কোন উপায় থাকে না।

পানছড়ি কলেজের প্রভাষক ত্রিরতন চাকমা ও পানছড়ি টিএন্ডটি টিলা সার্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট দেবমিত্র ত্রিপুরা জানান, পার্বত্য ৩ জেলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মাঝে নতুন করে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে। সামাজিক এ উৎসবকে ঘিরে পানছড়ির রিয়াংছড়া পাড়া, শান্তি পুর , টিএন্ড টি টিলা, মন্জু আদাম,বাবুরা পাড়া আগামী ১১ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৪ দিনব্যাপী বৈসাবি র‍্যালি, ফুল পূজা, বৈসাবি নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সার্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটি।

Related Articles

Back to top button