Breakingসারাদেশ

শহিদদের স্মরণে তিন দিনব্যাপী শ্রীনগরে ত্রিবেণী চিত্র প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য মেলা শুরু

স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সিগঞ্জ :
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের রাঢ়ীখাল ইউনিয়নের বালাসুর বিক্রমপুর যাদুঘর প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে ত্রিবেণী চিত্র প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য মেলা। রবিবার ১৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে চলবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। শহিদদের স্মরণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ আয়োজন করা হয়েছে।

 

 

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন,বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ অধ্যাপক মুজাহেরুল হক ।স্বাগত বক্তব্য রাখেন আব্দুল লতিফ, সদস্য সচিব, ত্রিবেণী চিত্র প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য মেলা।

 

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন: নাসির উদ্দীন জুয়েল, কিউরেটর, বিক্রমপুর যাদুঘর,ডাঃ অধ্যাপক আব্দুল মালেক, সভাপতি, বিক্রমপুর যাদুঘর, শ্রীনগর উপজেলা শাখা। ডা. জসিমউদ্দীন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা , কবি ও সাংবাদিক আশফাকুজ্জামান ,আবু সাঈদ, সভাপতি, মুক্ত আসর,আয়শা জাহান নূপুর, প্রতিষ্ঠাতা, নৈঋত স্টুডিও ইউসুফ রানা, প্রধান শিক্ষক, আলেমন নেছা হাই স্কুল ।আবু কালাম, প্রধান শিক্ষক, বিসমিল্লাহ কিন্ডারগার্ডেন এন্ড হাই স্কুল আয়োজনে ছিল নৈঋত স্টুডিও, এবং সহযোগিতায় ছিল মুক্ত আসর ও স্বপ্ন ৭১ প্রকাশন।

 

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মর্টার শেলের হামলায় যে তিন বোনসহ ১৬ জন শহিদ হয়ে ছিলেন তাঁদের স্মরণ করতেই আমাদের এই ত্রিবেণী চিত্র প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য মেলার আয়োজন। ইতিহাসের এই করুণ অধ্যায় নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণে রাখতে ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ মেলা আয়োজন করেছি।

 

উল্লেখ্য, প্রদর্শনীতে শহিদদের ছবির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা ঘটনার চিত্র, তথ্যচিত্র ও সচেতনতামূলক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকরণ প্রদর্শন করা হয়েছে।

 

এক সংগ্রামী পিতার গল্প: মো. সামসুল হক। এক সময় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশসহ সমগ্র অঞ্চল ছিল কলকাতা শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন। তখনকার দিনে মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই গ্রামের স্কুলগুলোতে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো। অনেক সময় মুসলিম সন্তানদের ভর্তি নিতেই চাইত না স্কুলগুলো।

 

এই বৈষম্যময় পরিবেশে এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মুসলিম ঘরের ছেলে মো. সামসুল হক ১৯৩৮ সালে কলকাতা বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এই অভাবনীয় সাফল্যের খবর।

 

স্থানীয় জমিদার খবর পেয়ে লোক মারফত ডেকে পাঠান ছেলেটিকে। খালি পায়ে ভোর থেকে অপেক্ষায় থাকা সামসুল হককে জমিদার প্রশ্ন করেন, “তুই নাকি পাস দিছোস ? -হ্যাঁ ঠাকুর। আগামীকাল থেকে তুই গদিতে বসবি, ব্যবসার হিসাব রাখবি।”

 

কিন্তু সেই রাতে তিনি পালিয়ে যান কলকাতায় ভর্তি হন ইন্টারমিডিয়েটে। এভাবেই শুরু হয় তাঁর শিক্ষা ও আত্মনির্ভরতার সংগ্রাম।

 

এই সামসুল হক-ই পরবর্তীতে হলেন শহীদ আছমা, নাজমা ও ফাতেমার পিতা যারা ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের ঘাসিয়াপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মর্টার শেলে শহীদ হন।তাঁর আদি বাড়ি মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকূলে। চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকায় থাকেন চাকরির সুবাদে। চাকরি করেন চট্টগ্রাম রেলওয়ের হিসাব বিভাগে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পর বিচ্ছিন্নভাবে দেশের সর্বত্রই অস্থিরতা বিরাজ করলে তিনি তার পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেন ঘাসিয়াপাড়ার এক অবস্থাপন্ন বাড়িতে। সর্বসাকুল্যে সেখানে আশ্রয় নেয় ৬৫ জন। সামসুল হক সাহেবের বড় ছেলে তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে তখন সে বাড়ির বাইরে। প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য অনেকের সাথে আশ্রয় নেয় চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ওয়াহিদ উদ্দিন আহমেদের বাড়িতে। বাকি ৩ ছেলে ও ৫ মেয়েকে নিয়ে তিনি ঘাসিয়াপাড়ায় আশ্রয় নেন।

 

সময় ৩ এপ্রিল ১৯৭১। ভোর বেলা, কেউ কেউ ঘুমে, কেউ কেউ জেগে উঠেছে কেবল। পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টার শেলে প্রাণ হারায় আশ্রিত মোট ১৬ জন। তাদের মধ্যে রয়েছে সামসুল হকের তিন মেয়ে। আসমা বেগম ও ফাতেমা বেগম সাথে সাথেই মারা যায়। আরেক মেয়ে নাজমার রক্তক্ষরণ থামছে না। চিকিৎসার জন্য কোথাও নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। চারপাশ ঘিরে রেখেছে পাকিস্তান বাহিনী। নাজমা বার বার বলছে, আমার ভাই মেডিকেলে পড়ে। আমাকে রক্ত দিলে আমি বেঁচে যাবো। আমাকে বাঁচান। রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। অনেক কষ্টে স্থানীয় এক ডাক্তারে বাড়িতে নেয়া হয় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু রক্ত সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। কবর খোঁড়া হয়েছে একটা। নামানো হয়েছে দুটো লাশ। অপেক্ষা করছে বাকি একজন মরে গেলে তাকেও এক কবরেই রাখা হবে। অবশেষে ব্যাপক রক্তক্ষরণে শেষ পর্যন্ত মারা যায় নাজমাও। তিন বোনের এক কবর।সামসুল হকের আরেক মেয়ের বুকের এক পাশ উড়ে যায়। তিনি এখনো বেঁচে আছেন এই চিহ্ন নিয়ে ঠিক একই ভাবে তার ছোট ছেলের শরীরেও আছে শেলের চিহ্ন। ঐদিনে আহতের সংখ্যা ছিল অনেক। পরিবারের অন্য ৬ জনও আহত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের এমন আত্মত্যাগের ঘটনাগুলোও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 

 

এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে নৈঋত স্টাডিও, সহযোগিতা মুক্ত আসর ও স্বপ্ন ৭১ প্রকাশন নামে দুটি সংস্থা।মুক্ত আসরের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবু সাঈদ। তিনি বলেন, এই প্রদর্শনী মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্যাগ স্বীকার করা মানুষের অজানা গল্পের প্রতিফলন। এটি শুধু শিল্পের জন্য নয়, বরং বিস্মৃত স্বপ্ন, সাহস ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর অনন্য প্রয়াস।নৈর্ঋত স্টুডিও প্রতিষ্ঠাতা আয়শা জাহান নূপুর জানান, এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ওই তিন বোনের ব্যবহৃত পোশাক।

 

 

ত্রিবেণী প্রদর্শনীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের মর্টার শেলের হামলায় একসঙ্গে শহীদ হওয়া তিন বোনের স্মৃতি তুলে ধরা হয়েছে চিত্রকলা, ইনস্টলেশন, ভিজ্যুয়াল মাধ্যম এবং তাদের ব্যবহৃত পোশাকের প্রদর্শনীর মাধ্যমে। স্থান পেয়েছে মোট ২৫টি শিল্পকর্ম।

 

বক্তব্য দেন শহীদ তিন বোনের বড় ভাই বিশিষ্ট জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক। তিন বোনের সাদাকালো একটি মাত্র ছবি সম্বল করে তাঁদের বিভিন্ন ধরনের ছবি এঁকেছেন শিল্পীরা।ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শহীদের ছোট ভাই আবদুর রহমান বাবলু। এখানে স্থান পেয়েছে তরুণ শিল্পী প্রশুন হালদার, মৃৎমন্দির গুঞ্জন কুমার রায়, জয়তী বিশ্বাস, সারাহ জাবীনের মতো কয়েক জন শিল্পীর কাজ।

 

এ প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য জনসাস মেলা চলবে আগামী ১৪ থেকে ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত দর্শকের জন্য উন্মুক্ত থাকবে প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য মেলা ত্রিবেণী। জলরং, তেল রং ও দৃশ্যমাধ্যমে তারা ফুটিয়ে তুলেছে শহীদ আসমা, নাজমা ও ফাতেমার শৈশব থেকে সেইদিন পর্যন্ত।

Related Articles

Back to top button