পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছরেও শান্তি অধরা, দিন দিন বাড়ছে নতুন নতুন সশস্ত্র সংগঠন
পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি : ২ ডিসেম্বর ; পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি । পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ তম বর্ষপূর্তির পরও চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে হতাশা আর ক্ষোভ । পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো। হানাহানি আর ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে পার্বত্য অঞ্চল এখনো অশান্ত। সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ শর্ত পূরণ করা হলেও পার্বত্য আঞ্চলিক সংগঠন গুলো বা উপজাতীয় নেতারা তাদের শর্ত গুলো পূরণ হয়নি বলে মত ব্যক্ত করছেন। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা না করা নিয়ে পাহাড়ীদের মাঝে যেমন রয়েছে হতাশা, তেমনি পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের মাাঝে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে প্রবল বিরোধীতা।
চুক্তির প্রধান শর্ত হিসেবে পার্বত্যাঞ্চলের সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠনগুলো তাদের অবৈধ অস্ত্রই এখনও জমা দেয়নি বরং তাদের বহরে ক্রমান্নয়ে যুক্ত হচ্ছে এসএমজি, এলএমজি, রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল সহ অত্যাধুনিক মরণাস্ত্র। প্রতিনিয়তই এই সব মরণাস্ত্র ব্যবহার করে তারা পুরো পার্বত্যাঞ্চলে একের পর এক হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে এলাকায় শান্তির পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পরেও পাহাড়ে থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। এখনো গোলাগুলির শব্দে গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গে এলাকার বসবাসরত সাধারণ মানুষের । সশস্ত্র সংঘর্ষে পড়ছে লাশের পর লাশ।
শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পরেও অব্যাহত রয়েছে পাহাড়ী আঞ্চলিক দলগুলোর সন্ত্রাসী বাহিনীর আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। থেমে নেই পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ( সন্তু লামার গ্রুপ ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, (মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা গ্রুপ ) পার্বত্য জনসংহতি সমিতি সংস্কারপন্থী ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট ( ইউপিডিএফ ) নামের সংগঠনগুলোর সশস্ত্র কর্মকান্ড ও চাঁদাবাজি।
এ ছাড়াও পাহাড়ে নতুন করে জন্ম নিয়েছে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ) নামে সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি বিলাই ছড়ি সীমান্ত ঘেঁষা দূর্গম পাহাড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা কিছু তরুন জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এমন সংবাদের ভিত্তিতে এইসব দূর্গম এলাকায় সেনাবাহিনী ও র্যাবের সন্ত্রাস বিরোধী চিরুনি অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৭জন এবং পাহাড়ি বিছিন্নতা বাদী সংগঠনের ৩ জন সহ মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এসময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। বর্তমানেও চলমান রয়েছে বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়িতে যৌথ বাহিনীর অভিযান।
এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে চারটি সংগঠনের পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি এবং বাঙালি-পাহাড়ীদের ভূমি জটিলতাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমন এক অবস্থার কারণে পাহাড়ে এখনও ফিরেনি শান্তির পরিবেশ। এখনও ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে পাহাড়ে ঝরছে রক্ত। থামেনি অভ্যন্তরীণ হানাহানি। এ কারণে শান্তি চুক্তির এই ২৫ বছরে এসে ওই শান্তি চুক্তির কিছু ধারা পরিবর্তন বা ‘রিভিউ’ করার জোরালো দাবি তুলেছেন পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ বাঙালি নেতারা।এছাড়াও শান্তিচুক্তির ২৫ বছরে চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে নানারূপ অভিমত প্রকাশিত হয়েছে।
কোনো কোনো মহল এই চুক্তির বিপক্ষে যেমন নেতিবাচক সমালোচনা করেছে অন্যদিকে বিভিন্ন দেশীয় আর্ন্তজাতিক মহল কর্তৃক ব্যাপক ভাবে প্রশংসিতও হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অভিযোগ শান্তি চুক্তি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি অপর দিকে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি তথ্য সরকার চুক্তির অধিকাংশ শর্তই বাস্তবায়ন হয়েছে বলে দাবী করে আসছে।
জানা যায়, দেশের এক-দশমাংশ পার্বত্য অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী লড়াই বা হানাহানি বন্ধ করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার উপজাতি সশস্ত্র সংগঠন জেএসএসের সঙ্গে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি করেছিলেন।বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) সেই পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পূর্ণ হলো। সরকার চুক্তির পরে দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামের অঞ্চলে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি সহ সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ফলে সাময়িক ভাবে বন্ধ হয় দীর্ঘদিন ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত। কিন্তু সেটি বেশিদিন বিরাজ করেনি। বরং শান্তি চুক্তির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে পাহাড়িদের একটি পক্ষ। যার অন্যতম হচ্ছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। যদিও বিভিন্ন সময়ে সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য শান্তি প্রতিষ্ঠা না হওয়ার জন্য সরকারকেই দোষারোপ করেন প্রতিমন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী সন্তু লারমা। এ সময় হুঁশিয়ারি সংকেত দিয়ে সন্তু লারমা আরও বলেন, ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পেছনে যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণ তাদের অস্তিত্ব সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর।’
জানা যায়, জেএসএসের (সন্তু লারমা) সঙ্গে সরকারের চুক্তির ফলে সব সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পান সন্তু লারমা। ফলে জেএসএস ভেঙে তাৎক্ষণিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রসীত খীসার নেতৃত্বে গঠন সশস্ত্র সংগঠন ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-প্রসীত)। এরপর হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (সংস্কার)। নতুন নতুন দল ও বাহিনী গঠিত হয়ে জড়িয়ে পড়ে চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণের মতো অপকর্মে । এই সংগঠন গুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ এবং আধিপত্যের কারণে বেড়েছে রক্তক্ষয়ী লড়াই ও সংঘাত।
অভিযোগ রয়েছে, বেপরোয়াভাবে ওইসব অপকর্ম ঘটালেও কঠোর ভাবে তাদের দমন করা হচ্ছে না। উল্টো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সুযোগ নিয়ে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী সহ পার্বত্য অঞ্চলের নিরীহ বাঙালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও পোপাগান্ডা চালাচ্ছে তারা।
চুক্তির পরে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে চার আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জড়িয়ে পড়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে। এলাকা আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে মারা যাচ্ছে বহু মানুষ। এই সময় পাহাড়ে একমাত্র শান্তিপূর্ণ এলাকা ছিল বান্দরবান। কিন্তু এখানেও সম্প্রতি মগ বাহিনী নামে তৈরি হয় একটি সশস্ত্র গ্রুপ। এই বাহিনী গঠনের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও জেএসএস উভয় দল থেকে মারা যান অনেক নেতাকর্মী। এর কারণ হিসেবে পাহাড়ি নেতারা চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াকেই দায়ী করছেন।
সরকার কর্তৃক ক্রমান্বয়ে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করা সত্বেও পার্বত্য আঞ্চলিক দলগুলো সরকারকে সহযোগিতা না করে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা নেই মর্মে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া জেএসএস ও ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা প্রতিনিয়ত সংর্ঘষ, অপহরণ, গুম, হত্যা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নানাবিধ অপরাধমূলক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তাদের এই অপকর্মের শিকার হচ্ছে এখানকার সাধারণ মানুষ। আর আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর এইসব অপ তৎপরতা মূলক কার্যক্রমের কারণে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নকে যেমন ব্যাহত করছে তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান শান্তিও বিনষ্ট করছে। এই প্রেক্ষাপটে পাহাড়ে শান্তি রক্ষায় এবং শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকান্ড অব্যাহত রাখা, অবৈধ অস্ত্রধারীদের রিরুদ্ধে জোরালো অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতা, সহবস্থানের মনোভাব ও সাম্প্রদায়িক বৈরিতা-বৈষম্য ভুলে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।