খাগড়াছড়িপার্বত্য অঞ্চলশিক্ষা / চিকিৎসা

শিক্ষক সংকটে রামগড়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে

চেঙ্গী দর্পন প্রতিবেদক , রামগড় , খাগড়াছড়ি  :
প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের শহর রামগড় । সৌন্দর্যের পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রেও বেশ এগিয়েছিলো রামগড়। এই শহরের বিভিন্ন বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে গবেষক, চিকিৎসক ,প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষক সহ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু বর্তমানে এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। প্রাথমিক,মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক সংকট ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে । শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে অভিভাবক মহল এবং সচেতন সমাজ। মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা কর্মকর্তা নেয়। অফিস সহকারি দিয়ে পুরো উপজেলার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে কোনরকম জোড়াতালি দিয়ে চলছে লেখাপড়া।

 

 

রামগড় মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়,মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে অনুমোদিত বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার সংখ্যা ৯টি । এর মধ্যে রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৭টি শিক্ষক পদের স্থলে শিক্ষক সংখ্যা ৯জন। শূণ্যপদের সংখ্যা ৮টি । এর মাঝে আবার খন্ডকালীন শিক্ষক ২জন । রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২১টি শিক্ষক পদের বিপরীতে শিক্ষক রযেছে ১১ জন এবং শূণ্য পদের সংখ্যা ১০টি। খন্ডকালীন শিক্ষক রয়েছে ৭জন। রামগড় বলিপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৭ জনের পরিবর্তে শিক্ষক রয়েছে ১৩জন। এর মাঝে খন্ডকালীন কালীন ৫ জন একই দূরাবস্থা চৌধুরী পাড়া জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় এবং নাকাপা উচ্চ বিদ্যালয়ে ও। এদিকে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ে দীর্ঘ ২মাস ধরে মাধ্যমিক কর্মকর্তা নেয়। ৭টি পদে রয়েছে মাত্র ২জন। ১ জন অফিস সহায়ক এবং একাডেমিক সুপার ভাইজার দিয়ে পুরো উপজেলার শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

 

এদিকে রামগড় সরকারি ডিগ্রী কলেজের অবস্থা আরো ভয়াবহ । উচ্চ মাধ্যমিক থেকে বিএ পর্যন্ত ২২ জন শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে ১২জন। বিভাগ ভিত্তিক অধিকাংশ শিক্ষক পদই শূণ্য। কোন বিভাগেই পরিপূর্ণ শিক্ষক নেয়। গণিত বিভাগের শিক্ষক না থাকায় গত চার মাস ধরে কোন ক্লাসই হয়নি। এর মাঝে গণিত,দর্শন ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের তিনজন শিক্ষক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে থাকায় শিক্ষক সংকটের কারণে পাঠদান পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে।

 

 

রামগড় সরকারি ডিগ্রী কলেজের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মংশাজাই মারমা বলেন, প্রায় সময় কোন না কোন পদ খালি থাকে। যেমন এখনও মানবিক বিভাগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কোন শিক্ষক নেই। দীর্ঘদিন যাবত উপাধ্যক্ষের পদ ও শুন্য রয়েছে। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষক থাকা বাঞ্চনীয় অথচ পদ সৃজিত থাকলেও আইসিটি এর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এ যাবত কোন শিক্ষক ছিল না,একজন খন্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান দেয়া হলেও কয়েকমাস আগে তারও অন্যত্র চাকুরী হয়েছে। তিনি আরো জানান, বর্তমান অধ্যক্ষ রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর হওয়ায় তিনি প্রায় ২ বছর ক্লাস নিয়ে আসছিলেন, স্যার ও এই জুনের ২ তারিখ পিআরএল চলে যাবেন। আগামী ২৮ এপ্রিল এর মধ্যে বাংলা ১ জন, হিসাব বিজ্ঞান ১ জন,অর্থনীতি ১জন , প্রাণি বিদ্যা ১ জন জয়েন করার কথা রয়েছে ৪১ তম বিসিএস থেকে। যদি তারা জয়েন করে তারপরও ৬ টি পদ বাকী থাকবে।

 

 

রামগড় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৪৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষকের পদ রয়েছে ২৫৭টি । ৪১টি শিক্ষকপদ এখনো শূণ্য।উপজেলার ৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন প্রধান শিক্ষকের পদ নেয়। প্রধান শিক্ষক ছাড়াই পরিচালনা করা হচ্ছে এসব বিদ্যালয়। উপজেলার বালুখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গুজাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ১ জন করে শিক্ষক দিয়ে কয়েক শত শিক্ষার্থীকে পাঠদান দেয়া হচ্ছে।

 

সরেজমিনে বিভিন্ন বিদ্যালয় গুলো ঘুরে দেখা যায়,সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোতে।শিক্ষক সংকটে শিক্ষার মান তলানীতে।স্বল্প টাকায় খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে জোড়া তালি দিয়ে লেখাপড়া পরিচালনা করা হচ্ছে।বেশিরভাগ বিদ্যালয়গুলোতে বিভাগভিত্তিক শিক্ষক সংকট তীব্র আকার ধারণ করা হচ্ছে।সদ্য পড়াশুনা শেষ করে আসা অনভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান,ব্যবসা এবং মানবিকের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। এতে দিশেহারা হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থী সহ অভিভাবকেরা। রামগড় সরকারি ডিগ্রী কলেজে গিয়ে দেখা যায় পুরো কলেজে শিক্ষার্থী সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ শ্রেণী কক্ষ ফাকা।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এবং রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, এ দূরাবস্থা অনেকদিনের। বাংলা, ইংরেজি,কৃষি শিক্ষা, গণিত সহ বিজ্ঞান বিভাগের অনেক শিক্ষক পদ শূণ্য। পুরোপুরি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না তাঁরা। স্থানীয় কোচিং গুলোতে পড়ে জোড়াতালি দিয়ে পড়াশোনা করতে হচ্ছে।

 

অভিভাবক শ্যামল রুদ্র উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, সন্তানদের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রত্যেকেই চিন্তিত।উন্নত শিক্ষার জন্য বাইরে নিয়ে তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। এ রকম দূরাবস্থার প্রেক্ষাপটে গরীব মা-বাবা প্রশ্ন এটাই কী সন্তানদের ভবিতব্য!

 

রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক রাশেদুল ইসলাম জানান,বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট চরমে।শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার মান ও ব্যহত হচ্ছে।আমাদের টানা ক্লাস নিতে হয়।অতিরিক্ত ক্লাসের চাপ সামলানোর পাশাপাশি পরীক্ষার খাতা দেখাসহ নানা কাজে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।প্রয়োজনে ছুটিও নেওয়া যায় না।

 

রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন,বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণের কারণে শ্রেণী কক্ষের সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট রয়েছে। খন্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে কোনরকম শিক্ষাদান এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।

 

শিক্ষার এই দূরাবস্থা দেখে রামগড়ের সন্তান কাস্টমস কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে রামগড় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। নব্বই দশকেও রামগড়ের বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক পদ শূণ্য ছিলোনা। অথচ বর্তমানে শিক্ষক সংকটে এই অঞ্চলের শিক্ষার মান তলানীতে ঠেকেছে। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীরা সন্তোষ জনক ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ।

রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কারবারী বলেন, এ বিষয়টি খুবই দু:খজনক।একাধিকবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে শিক্ষক সংকটের কথা জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।নির্বাচনী ব্যস্ততা কেটে গেলে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের নিয়ে শিক্ষক সংকট কাটিয়ে রামগড়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিবেন।

খাগড়াছড়ি মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম মোসলেম উদ্দীন জানান, রামগড়ে শিক্ষক সংকটের কথা তিনি শুনেছেন। নন ক্যাডারে অনেক শিক্ষক সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছে।মাস দুয়েকের মাঝে উপজেলার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট কেটে যাবে বলে জানান তিনি। আর বেসরকারি এবং এমপিও ভুক্ত বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক সংকট কাটাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হবে।

Related Articles

Back to top button