পার্বত্য চট্টগ্রামে বুদ্ধ ধর্ম নবজাগরণের অগ্রদূত অগ্রবংশ মহাথের’র ১২তম প্রয়ান দিবস পালনের প্রস্তুতি সম্পন্ন
সাংবাদিক এস চাঙমা সত্যজিৎ , বিশেষ প্রতিনিধিঃ আজ ৫ জানুয়ারী ২০২২ বুধবার পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্মের নবজাগরণের অগ্রদূত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ প্রয়াত শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাথের রাজগুরু ভন্তের ১২ তম মহাপ্রয়ান দিবস। এই দিবসটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধজাতির একটি স্মরণীয় দিন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে ৫ জানুয়ারী পানছড়ি উপজেলা সদরে জ্ঞানোদয় বৌদ্ধ বিহারে সকাল ০৯টা হতে সাড়ে ১২টার মধ্যে স্মরণ সভা ও পূণ্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
প্রয়াত রাগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাথের পার্বত্য চট্টগ্রামের বুদ্ধ ধর্মের নবজাগরণের অগ্রদূত, পার্বত্য ভিক্ষু সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা, বহু ধর্মীয় গ্রন্থের প্রণেতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ত্রিপিটক বিশারদ, ৬ষ্ঠ সংগীতি কারক, পার্বত্য চট্টগ্রামের মহামান্য প্রথম সঙ্ঘরাজ।
তিনি ১৯১৩ সালে ২৩ নভেম্বর রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি থানার অন্তর্গত কুতুবদিয়া গ্রামে এক সম্রান্ত বৌদ্ধ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মের পর পূর্ণিমা চাঁদের মত ফুটফুটে ও ফুলের মতন চেহারা হওয়ায় তাঁর নাম রাখা হয় ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা। পরিপূর্ণ যৌবনে ২২ বছর বয়সে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রাইংখ্যং বগলতলী বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ উঃ তিষ্য মহাস্থবির’র নিকট প্রবজ্জ্যা ধর্মে (শ্রামণ) দীক্ষিত হন। প্রবজ্জিত জীবনে তাঁর নাম রাখা হয়েছে অগ্রবংশ শ্রামণ। অগ্রবংশ শ্রামণ গুরুদেবের সাহচর্য্যে কিছুদিন থাকার পর রাঙ্গুনিয়া ইছামতি ধাতুচৈত্য বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ পণ্ডিত শ্রীমৎ ধর্মাধার মহাথের’র তত্ত্বাবধানে চলে যান। তাঁর (ধর্মাধর) নির্দেশনায় পাঠ গ্রহণে পালি ভাষায় ও সাহিত্য বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। আচার্যদেবের (ধর্মাধার) ব্যবস্থাপনায় অগ্রবংশ শ্রামণ ত্রিপিটক শাস্ত্রে অদ্য, মধ্য, উপাধি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তিনি (অগ্রবংশ) রাঙ্গুনিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাস করেন।
অগ্রবংশ শ্রামণ ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে শুভ বৈশাখীর পূর্ণিমার দিনে (পূর্ণিমা তিথি) নিজ গ্রামেনর বগলতলী বৌদ্ধ বিহাবরে পার্শ্বস্থ উদক সীমায় শ্রীমৎ উঃ তিষ্য মহাথের’র উপাধ্যায়াত্বে শুভব উপসম্পদা (ভিক্ষুত্ব) লাভ করেন। পূর্বের নামানুসারে তার নাম রাখা হলো অগ্রবংশ ভিক্ষু। গুরুদেবের (উঃ তিষ্য) সাথে কিছুদিন অবস্থানের পর অনুমতি নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে বেতিগী আশ্রমে গিয়ে ফিরে চলে আসেন।
আধ্যাত্ত্বিক ও উচ্চতর শিক্ষা নেওয়ার জন্য ব্রম্মদেশে গমণ করেন। সেখানে সূর্য উদয়ের সাথে সাথে মন্দির প্রাঙ্গনে শতশত ঘন্টার ধ্বনি, ধ্যান, সাধনা ও ভাবনা দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে পড়াশুনা শুরু করেন। রেঙ্গুনের লেৎপেরাং বিশ্ববিদ্যালয় ও কাসাইদেহা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি সাহিত্য এবং বৌদ্ধধর্ম নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন।
৬ষ্ঠ সংগীতি কারক অগ্রবংশ ভিক্ষু রেঙ্গুনে অবস্থানকালে ১৯৫৫-৫৬ সালে ভগবান বুদ্ধের ২৫০০ তম বুদ্ধ জয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব বৌদ্ধ জাতির ৬ষ্ঠ মহাসংগীতি। বুদ্ধধর্মে উচ্চ শিক্ষিত ভিক্ষু হিসেবে তিনি ৬ষ্ঠ বৌদ্ধ মহাসংগীতিতে যোগদানের নিমন্ত্রণপত্র লাভ করেন এবং সংগীতিতে যোগদান করেন। সে সময় ব্রম্মদেশ ও অন্যান্য বৌদ্ধ দেশ হতে আগত মহাজ্ঞানী ভিক্ষুদের সমন্বয়ে সুপ্রিম সঙ্ঘ কাউন্সিল গঠন করা হয়। সেই সুপ্রিম সঙ্ঘে অগ্রবংশ ভিক্ষুকে সদস্য পদ দেওয়া হয়। সে সম্মেলন অনুষ্ঠানে বিশাল ত্রিপিটক গ্রন্থ থেকে সতিপটঠান সূত্ত পাঠ করে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছেন অগ্রবংশ ভিক্ষু মহোদয়। তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ বার্মার বুদ্ধ শাসন কাউন্সিল তাঁকে অহ্রমহাপণ্ডিত উপাধিতে ভূষিত করেন। ৬ষ্ঠ মহাসংগীতিতে যোগদান করার জন্য বর্মা সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বৌদ্ধ প্রতিনিধি হিসেবে মহামান্য চাঙমা রাজা ত্রিদ্বীপ রায়কে আমন্ত্রণ জানান। সেই ৬ষ্ঠ বৌদ্ধ মহাসংগীতিতে সাক্ষাৎ হয় ভদন্ত অগ্রবংশ ভিক্ষু মহোদয়ের সাথে চাঙমা রাজা ত্রিদ্বীপ রায়ের। আলাপ চারিতায় জ্ঞানের গভীরতা উপলদ্ধি করতে পেরে চাঙমা রাজা অগ্রবংশ ভন্তেকে দেশে ফিরে এসে স্বধর্ম প্রচারে গুরু দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করেন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বার্মাদেশে ধ্যান-সমাধি ও ত্রিপিটক অধ্যয়নের পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে চাঙমা রাজ বিহারে রাজগুরু হিসেবে অভিসিক্ত হন।
অন্যদিকে ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নামে মাত্র বৌদ্ধ ছিলেন। ধর্মীয় কুসংস্কারসহ নানা প্রকার মিথ্যা দৃষ্টি এবং অবৌদ্ধ আচারণে ধর্মীয় কার্যক্রম প্রবল ছিল। লরি বা রাউলী পুরোহিত নামে এক শ্রেণীর ধর্মীয় পুরোহিত ছিলেন। তাঁরা কোন মতে ধর্মীয় কার্যাদি পরিচালিত করতেন।
শ্রদ্ধেয় রাজগুরু ভন্তে বার্মাদেশ থেকে এসে পার্বত্য বৌদ্ধ ভিক্ষু সমিতির মাধ্যমে সমগ্র পার্বত্য বৌদ্ধ এলাকা গুলোর মাঝে জাগরণ, ধর্ম প্রচারসহ ব্যাপকভাবে বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। তাঁর মাধ্যমে সমগ্র পার্বত্যবাসী বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্ম জাগরণের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়।
১৯৯৫ সালে রাজ পরিবার ও পার্বত্য অঞ্চলের ভক্তপ্রাণ দায়ক-দায়িকাদের কতৃক অগ্রবংশ ভন্তেকে সম্মান সূচক “”মহাস্থবির”” পদে অভিসিক্ত করা হল। উক্ত অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষও সমাগম হয়েছিল।
শ্রদ্ধেয় রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের ভন্তে ৯৫ বছর বয়সে ২০০৮খ্রিষ্টাব্দের ০৫ জানুয়ারী রাত সাড়ে ৯টায় বয়ঃবার্ধক্য কারণে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্ষুত্ব জীবন ৬৯ বর্ষ) মহাপ্রয়ান লাভ করেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর ৪-৬ তারিখে সরকারী-বেসরকারী এবং আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ জাতিদের উপস্থিতিতে তিনদিনব্যাপী বিবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, সেমিনার, শোক-সভাযাত্রাসহ যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় অন্তেষ্ঠিক্রিয়ানুষ্ঠান সুসম্পন্ন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান শেষের দিনে তাঁর বর্ণাঢ্য ভিক্ষুত্ব জীবনের শবদেহ ভষ্ম করে পার্বত্যাঞ্চলের অতীব গৌরবময় একটা শতাব্দীর অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বৌদ্ধ জাতিদের।