পাহাড়ে শান্তি চুক্তির সুফল আনতে আঞ্চলিক সংগঠনের অস্ত্র জমা জরুরী
চেঙ্গী দর্পন ,পার্বত্য অঞ্চল প্রতিবেদক :পাহাড়ে শান্তি চুক্তির সুফল আনতে শান্তির পায়রা উড়তে বাঁধা কেন? অনুসন্ধানে যা উঠে আসছে যেমন বলা যেতে পারে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৪ বছরেও অশান্তি কাটেনি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায়। থামনি হত্যা-গুম, অপহরণ আর চাঁদাবাজি নিত্য দিনের ঘটনা। সম্প্রতি নানা দলে-উপদলে হানাহানি বেড়েছে। চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণই এসব সংঘাতের মূল কারণ বলে এখানকার সচতন মহলের অভিমত। সবুজ প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর জনপদ পাহাড়ের তিন জেলাতে শান্তির পায়রা উড়িতে বাঁধা কেন প্রশ্ন রয়ে গছে পার্বত্যবাসীর মাঝে। এখানকার স্থানীয় শান্তি প্রিয় অধিকাংশ জনগনের অভিযোগ আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বছর জুড়ে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে শান্তিচুক্তির সুফল পাচ্ছেনা পার্বত্য জনপদের উপজাতি ও বাঙালিরা।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য জনসংহতি সমিতি এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়। এর মধ্যে দিয়ে ওই অঞ্চলে প্রায় দুই যুগের সশস্ত্র সংঘাতের অফিসিয়ালি অবসান ঘটলেও এখনো চলমান আছে হানাহানি, গুম, হত্যা ও চাঁদাবাজি। শান্তিচুক্তির দুই যুগ পূর্ব থেকে চাঁদাবাজি ও খুনো খুনিতে লিপ্ত পাহাড়িদের সাথে সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি হলেও দুই যুগ পরে এসেও সেই চাঁদাবাজিই শান্তি চুক্তির সুফল ভোগের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্বত্যবাসির সামনে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও অনেকেই আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা না দেওয়ায় পাহাড়ে সংঘাত থামছেই না।
পাহাড়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির নেতৃত্বদানকারি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে সেই চুক্তিতে সই করেছিলেন দলের প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধি প্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। চুক্তির বলে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের দুই যুগ ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। কিন্তু সন্তু লারমার সেই দল কয়েক দফায় ভেঙে এখন পাহাড়ে চারটি দল সক্রিয় রয়েছে। সেগুলো হল- পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (সংস্কার )। এসব দলে কোন্দলে পাহাড়ে রক্ত ঝরছে প্রায়ই, গত মঙ্গলবারও (৩০ নভেম্বর) সর্বশেষ রাঙামাটি জেলাতেও একটি হত্যাকান্ড ঘটেছে।
নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির ক্ষেত্র দখল-বেদখল নিয়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নানা সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত রয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ আর চাঁদাবাজির ঘটনায় ভীত সন্ত্রস্থ পাহাড় বাসী। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৭১টিই সরকারের বাস্তবায়নের কথা। সরকারি হিসাব অনুযায়ি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছেন ৪৮টি, আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে ১৫টি, চলমান অবাস্তবায়িত রয়েছে ৯টি ধারা। তৎমধ্যে শুধু একটি ধারা বাস্তবায়নের কথা পাহাড়িদের। আর তা হলো, তারা অস্ত্র জমা দেবেন। কিন্তু তারা সেটি পুরোপুরি করেননি বলে অভিযোগ পার্বত্যাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত যৌথ বাহিনীর।
সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুসারে, গত এক বছরে পাহাড়ে বিবদমান সন্ত্রাসীদের মধ্যে চাঁদাবাজির ক্ষেত্র দখল-বেদখল নিয়ে নিহত হয়েছে অন্তত ৩৬ জন। ২০১৩ সালের পর সরকারি দল আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ৫ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে একশ’র বেশি। চুক্তির পর এ পর্যন্ত ২৪ বছরে পাহাড়িদের ৪ সংগঠন আক্রমণ চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ১৬ সদস্য, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৪৮০ জন এবং ১৯০ জন বাঙালি হত্যা করেছে। এ সময় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৬৬০ জন এবং ৬৫০ জন বাঙালি আহত হয়েছেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৯১০ জন এবং ৩৮৪ জন বাঙালি অপহরণ হয়েছে। এছাড়া ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩ হাজারের বেশি অস্ত্র ও প্রায় আড়াই লাখ গোলা বারুদ উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) রাঙামাটির বন্দুকভাঙ্গা এলাকায় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) কর্মী আবিস্কার চাকমা (৪০) কে। তবে গত শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) ওই এলাকায় ইউপিডিএফ এর একটি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে একে-৪৭ রাইফেল সহ তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছিলো যৌথবাহিনী।
এছাড়া রয়েছে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কাজে ১০ শতাংশ চাঁদাবাজি আর হুমকির ঘটনা। পার্বত্যাঞ্চলে বাসিন্দা পাহাড়ি ও বাঙালি দুই পক্ষই বলছে, বাগান করতে, গাড়ি চালাতে, পণ্য বিক্রি করতে, সব কিছুতেই চাঁদা দিতে হয় বিবদমান আঞ্চলিক দল নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে।
বান্দরবানের থানছি বাজার পাড়ার বাসিন্দা উখ্যাই প্রু মারমা বলেন, পার্বত্য তিন জেলার একমাত্র সমস্যা ‘চাঁদাবাজি’। চাঁদার জন্য আধিপত্য, আর এই আধিপত্য বজায় রাখার জন্য যত হত্যাকা- ও অশান্তি। আঞ্চলিক দলগুলো বিভক্ত হওয়ায় খুন বেশি হচ্ছে। শান্তিচুক্তির আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে বললে তিনি বলেন, তখন সন্ধ্যার পর চলাচল করা যেত না, এখন যাতায়াত ব্যবস্থা, বিদ্যুতায়নসহ সরকারের নানামুখি উন্নয়নের ফলে রাতেও চলাচল করা যায়। তবে এখন চাঁদাবাজি বেড়েছে। প্রতিবছর তার আনারস ও কলা বাগান থেকেও চাঁদা দিতে হয় জানালেও কোন সন্ত্রাসী সংগঠন চাঁদা নেন তা বলতে নারাজ উখ্যাই প্রু মারমা।
চাঁদা আদায়ে কতিপয় বাঙালিরাও জড়িত জানিয়ে বান্দরবান সদরের ফারুখ পাড়ার ব্যবসায়ি উবামং অনন্ত বলেন, এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখান থেকে চাঁদা আদায় হয় না। ভয়ে হোক আর লাভের জন্য হোক, পাহাড়ের সশস্ত্র চারটি সংগঠনের চাঁদা আদায়ের কাজে বাঙালিদের একাংশও জড়িত রয়েছে। বিকাশ, নগদসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রসারে পাহাড়ে চাঁদা আদায় এখন সহজ হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বলেন, অন্য পার্বত্য জেলার তুলনায় বান্দরবানে সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাবে ১১টি জাতি গোষ্ঠী বসবাস করছে। পাহাড়ের ৯৫ ভাগ মানুষ শান্তি চায়। বর্তমানে পাহাড়ে শান্তি চুক্তির সুফল আনতে আঞ্চলিক সংগঠনের অস্ত্র জমা জরুরী হয়ে পড়েছে।