চট্টগ্রাম :
দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র টানেল উদ্বোধনের পর আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। দেশের আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে সম্ভাবনার আরো একটি নতুন দুয়ার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রত্যাশিত এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের আনুষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞ শুরুর মধ্য দিয়ে। বঙ্গোপ সাগরের তীরে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতার বাড়িতে নির্মিতব্য এই গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে পুরো একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে।
শুধু তা-ই নয়, গভীর সমুদ্র বন্দর ছাড়াও মাতার বাড়িতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মিত হচ্ছে, যা ওই অঞ্চলে বিপুল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন এবং দক্ষিণ এশিয়ার ‘বিজনেস হাব’ হিসেবে গড়ে উঠছে মাতারবাড়ি।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌপথে ৭০ কিলোমিটার দূরে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রকল্পটি ২০২০ সালের মার্চে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। সেপ্টেম্বরে জাপানের নিপ্পন কোই নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে টার্মিনালের নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছে। ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্র আহবানের পর কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
মাতার বাড়িতে এরই মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সামগ্রী বহনকারী জাহাজ চলাচলের জন্য একটি চ্যানেল খনন এবং দুটি জেটি নির্মাণ করে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। চ্যানেলটি ১৪ দশমিক ৩ কিলো মিটার দীর্ঘ, ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ও ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর। বাংলাদেশে এটি সবচেয়ে গভীর চ্যানেল।
আগামী ১১ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহেশ খালীর মাতার বাড়িতে গভীর এই সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন এবং গভীর সমুদ্র বন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন করবেন।
৯ নভেম্বর ২০২৩ বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্রস্তুতি মূলক কার্যক্রম পরিদর্শন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার সিম্বল হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে দুই থেকে তিন বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে। সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন খরচ ১০ থেকে ২০ ভাগ কমে আসবে। দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের আবিষ্কারক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বন্দরের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে সারা বিশ্বে পরিচয় করে দিয়েছেন। গভীর সমুদ্রবন্দর এখন দৃশ্যমান। এর ফলে দেশের অর্থনীতি আরও বেশি শক্তিশালী হবে। মহেশখালীর মাতারবাড়ি শহর হবে। এখানে বিপুল সংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিন বছরের মধ্যেই গভীর সমুদ্রবন্দর তার অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং প্রথম টার্মিনালে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হবে।
জাপান সরকারের সহায়তায় জাইকার অর্থায়নে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেটির অদূরে ও সাগর উপক‚ল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে নির্মাণ হবে গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) থেকে অধিগ্রহণ করা চ্যানেলটি চালুর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বাত্মক প্রস্তুতি। ২০২৬ সালে বন্দরটির কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি বলেন, সেদিন ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কন্টেইনার জেটি এবং ১৮.৫ মিটার ড্রাফ্ট (জাহাজের নিচের অংশ)সহ ৩০০ মিটার দীর্ঘ একটি বহুমুখী জেটি এবং একটি কন্টেইনার ইয়ার্ডসহ বন্দর অন্যান্য সুবিধার নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এই উন্নয়নের ফলে ৮০০০ থেকে ১০,০০০ কন্টেইনার জাহাজ সরাসরি জেটিতে প্রবেশ করতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ইন্দোনেশিয়ার একটি জাহাজ ভেড়ার মধ্য দিয়ে চ্যানেলটি চালু হয়। এরপর গত তিন বছরে ১২৩টি জাহাজ প্রকল্পের সরঞ্জাম ও কয়লা নিয়ে এ চ্যানেল অতিক্রম করে। গত সাতমাসে প্রায় আট লাখ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে ভিড়েছে বিশালাকৃতির ১০টি জাহাজ। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে চ্যানেলটির নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রাম বন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, ২০২৬ সালের শেষদিকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরে অন্তত ১৬ মিটার গভীরতা বা ড্রাফটের জাহাজ অনায়াসে প্রবেশ করতে পারবে। বড় বড় মাদার ভ্যাসেল আট থেকে ১০ হাজার কনটেইনার নিয়ে এখানে ভিড়তে পারবে। এক লাখ টন কার্গো নিয়ে এখানে জাহাজ আসতে পারবে। তিনি বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে পুরো একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে। এর মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ উপকৃত হবে তা-ই নয়, দক্ষিণ এশিয়া এবং চীনসহ আরও কয়েক দেশের অন্তত তিন শ কোটি মানুষ সুফল পাবে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন আতাউল হাকিম বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে চ্যানেলের উত্তর পার্শ্বে ২ হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ ও দক্ষিণ পার্শ্বে ৬৭০ মিটার দীর্ঘ ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ নিরোধক বাঁধ) নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কন্টেইনার জেটি ও ৩০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস জেটি নির্মাণ এবং কন্টেইনার ইয়ার্ডসহ বন্দর সুবিধাদি নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের সড়ক ও জনপথ অংশে ২৭.৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে মাতারবাড়ি বন্দরের সঙ্গে ন্যাশনাল হাইওয়ের সংযোগ স্থাপন করার কাজ চলমান রয়েছে। মাতারবাড়ি টার্মিনাল বাস্তবায়িত হলে ১৬ মিটার বা তার চেয়ে বেশি গভীরতা সম্পন্ন বাণিজ্যিক জাহাজ হ্যান্ডলিং করতে সক্ষম হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে মাইলস্টোন হিসেবে কাজ করবে। এই বন্দরে ভিড়তে পারবে বড় ধরনের ফিডার ভেসেল। ২০২৬ সালের মধ্যে আনুমানিক ০.৬ থেকে ১.১ মিলিয়ন টিইইউস (বিশ ফুট দৈর্ঘ্যরে কন্টেইনার) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আনুমানিক ২.২ থেকে ২.৬ মিলিয়ন টিইইউস কন্টেইনার কার্গো হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে। এতে করে বাঁচবে অর্থ ও সময়। যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।