ডেঙ্গুতে নাকাল চট্টগ্রামবাসী ; মশক নিধনে নামেই ‘ ক্রাশ প্রোগ্রাম’
শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতেও শংকিত অভিভাবকরা
চট্টগ্রাম :
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল সহ বিভিন্ চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারেও প্রতিনিয়ত জ্বর নিয়ে যাচ্ছে রোগিরা। করোনা মহামারির পর এবার ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন নগরবাসী।
কয়েকদিন পর পরই ঘটা করে মশক নিধনের ‘ ক্রাশ প্রোগ্রাম’ এর ছবি আর সংবাদ দেখে নগরবাসী। মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস ও বিস্তার রোধের জন্য সিটি কর্পোরেশনের যে দায়িত্ব ছিল তা তারা পালন করেনি বা করছেনা এমন অভিযোগ নগরবাসীর।
চট্টগ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই মশক নিধনের কোন ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়ে বেশি চিন্তিত তারা। স্কুলগুলোর আশপাশের নালা-নর্দমাগুলোও অপরিচ্ছন্ন। ডেঙ্গুর বিস্তারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদেরকে পাঠানো নিয়ে ভয়ের মধ্যে আছেন অভিভাবকগন।
চট্টগ্রাম নগরীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে শুধুমাত্র ফগার মেশিন দিয়েই মশক নিধনের ‘ ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালাতে দেখা গেছে। তাও নগরীর কিছু কিছু এলাকাতে সীমাবন্ধ। নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা এবং সেই সাথে সেগুলোতে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা যাচ্ছে না এখন পর্যন্ত। এরই মধ্যে নগরবাসীদের অনেকেই বলছেন, সিটি কর্পোরেশন শুধু বাড়তি হোল্ডিং ট্যাক্সই নিচ্ছে, কিন্তু নগরবাসীকে যে নাগরিক সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথা রয়েছে তা পালন করছেনা বা পালন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে গত চব্বিশ ঘণ্টায় ( সোমবার সকাল পর্যন্ত) আরও ৮১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রোগির সংখ্যা আরো বাড়ছে বলেই বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামে ডেঙ্গু প্রতিরোধ-চিকিৎসা ও এডিস মশার উৎপত্তিস্থলগুলো দ্রæত ধ্বংস করার জন্য সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ে একটি কার্যকরী সেল করা খুব জরুরী হয়ে পড়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন নাগরিকবৃন্দ।
আগে একসময় যেমন বলা হতো-এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতেই শুধু জন্মায় ও বংশ বিস্তার করে সে ধারনাটি বদলে গেছে। বছরখানেক আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সমন্বয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যে সমীক্ষা চালিয়েছিল তাতে দেখা গেছে শুধু পরিস্কার পানিতেই নয় নালা-নর্দমার নোংরা পানিতেও এডিস মশা জন্ম নেয় ও বংশ বিস্তার করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুকের নেতৃত্বোধীন ওই কমিটি নগরীর বিভিণœ স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন তাতে দেখা গেছে নালা-নর্দমার ময়লা পানিতেও এই এডিস মশার বংশবিস্তার হচ্ছে। ড. ওমর ফারুক বলেছেন – ‘এডিস মশার লার্ভা শুধু পরিস্কার পানিতে না, ময়লা পানিতেও আমরা পেয়েছিলাম। সুতরাং শুধু পরিস্কার পানিতে থাকে তা সত্য না। নগরীর কল্পলোক আবাসিক এলাকার একটি নালা থেকে অসংখ্য এডিসের লার্ভা সংগ্রহ করা হয়েছিল।’। চবি’র ওই টীম চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে বেশ কিছু পরামর্শ দিলেও তার কোন বাস্তবায়ন করেনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
১০ জুলাই ২০২৩ , সোমবার চট্টগ্রামের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন,‘এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে জন্মে যেমন ছাদ বাগানের টবে, নির্মণাধীন ভবনের জলাধারে, ডাবের খোসা,পরিত্যক্ত টায়ার টিউব, খালি বোতল ও বাডির আঙ্গিনায় জমে থাকা পানিতে।’ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জেনারেল হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে গিয়ে মেয়র এ মন্তব্য করেন। আবার গত রবিবার মেয়র যখন ড্রোন উড়িয়ে নগরীল বিভিণœ ছাদে জমা পানিতে ডেঙ্গুর প্রজনন কেন্দ্র খুঁজছিলেন সে দিনই জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে ১১১ জন রোগি ভর্তি ছিলেন বিভিন্ হাসপাতালে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, ফৌজদারহাটে অবস্থিত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে কমপক্ষে ১৫৮ জন চিকিৎসাধীন আছেন। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে জুলাই মাসেই ৩৭৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন চার জন। জুনে ২৮২ জন আক্রান্ত, মারা গেছেন ৬ জন। মে মাসে ৫৩ জন, এপ্রিলে ১৮ জন, মার্চে ১২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২২ জন এবং জানুয়ারিতে ৭৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন তিন জন।’
নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে দেখা গেছে রোগিরা মশারি টানিয়ে মশারির মধ্যে আছেন। কিন্তু রোগীর পরিচর্যাকারি আত্মীয়-স্বজন কিন্তু মশারির বাইরেই অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছেন জায়গার অভাবে। আর হাসপাতালগুলোতেও মশার উপদ্রপ বেশ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারি রেজিস্টার ডা. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, এবারের রোগীদের অবস্থা খুবই জটিল। খারাপ অবস্থা নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন তারা। এবার অন্য বছরের তুলনায় শনাক্তের হারও কয়েকগুন বেশি। তাই মশারি টাঙানোর পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।