Breakingঅপরাধখাগড়াছড়িজাতীয়পার্বত্য অঞ্চলবান্দরবানরাঙ্গামাটিরাজনীতিশীর্ষ সংবাদসম্পাদকীয়সারাদেশ

উপজাতীয় আঞ্চলিক দলের আধিপত্য বিস্তারে ২০২১ -এ রাঙ্গামাটিতে ৯টি প্রাণ ঝড়েছে

ডেক্স রিপোর্ট, চেঙ্গী দর্পন ,রাঙ্গামাটি :রাঙ্গামাটিতে ২৯ ডিসেম্বর দুই জন সহ ২০২১ সালে উপজাতীয় আঞ্চলিক রাজনীতির হানাহানি ও সহিংস ঘটনায় ৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের হানাহানীতে আহত হয়েছে প্রায় ২০ জনের বেশী অপহৃত হয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ। এ সবের মধ্যে চলমান ইউপি নির্বাচনি সহিংসতাও রয়েছে। মূলত পাহাড়ে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে আঞ্চলিক দল গুলোর মধ্যে প্রতিনিয়তই এ ধরেনের সহিংসতা আর হানাহানির ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় রাঙ্গামাটিতে বছরজুড়ে তৈরি করে ভীতিকর পরিস্থিতি এবং জনমনে সৃষ্টি করে উদ্বেগের।

সর্বশেষ বন্দুক যুদ্ধের ঘটনাটি ঘটেছে ২৯ ডিসেম্বর বাঘাইছড়িতে। এ ঘটনায় উপজেলার রূপকারী ইউনিয়নের পাকুজ্যাছড়ি ও দুই কিলোমিটার প্রশিক্ষণ টিলা নামক এলাকায় উপজাতীয় আঞ্চলিক দল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) দলের সমর্থিত সশস্ত্র দুই গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারান তুজিম চাকমা ও জানেন চাকমা। তুজিম ছিলেন জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের কোম্পানি কমান্ডার এবং জানেন ছিলেন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপের বাঘাইছড়ির পরিচালক।

পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ৪টি গ্রুপের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ লেগেই রয়েছে। পাহাড়ের এই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গুলো নিজেদের আধিপত্র বিস্তারকে কেন্দ্র করে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের উপর ষ্ট্রিম রোলার চালাচ্ছে বলে বরাবরই অভিযোগ রয়েছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পার্বত্য গহীণ অরণ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের নজর না আসায় তা প্রকাশ পায় না। এই নিয়ে কতো মায়ের বুক খালি হচ্ছে তা সংখ্যায় গননা নেই। শহর বা উপজেলার কাছাকাছি হতাহাতের বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে তা প্রশাসনের নজরে আসে এবং রিপোর্ট হিসাবে প্রকাশ পায় বলে মত ব্যক্ত করেন রাঙ্গামাটির সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।

ঘটনাবলির বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরের শুরুর দিকে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে ঢুকে সমর বিজয় চাকমা নামে এক ইউপি (ইউনিয়ন পরিষদ) সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। পার্বত্য এলাকায় সরাসরি কোনো সরকারি অফিসে ঢুকে এ ধরনের হত্যাকান্ড ছিল এটাই প্রথম। নিহত সমর বিজয় ছিলেন বাঘাইছড়ি উপজেলার রূপকারী ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য। এদিন তিন জন সশস্ত্র দুর্বৃত্ত একটি মোটরসাইকেলযোগে অতর্কিত গিয়ে তাদের একজন সরাসরি অফিসে ঢুকে সমর বিজয়কে গুলি করে আবার দ্রুতবেগে পালিয়ে যায়।


৩১ মার্চ একই উপজেলা বাঘাইছড়িতে জনসংহতি সমিতির সংস্কারবাদী দল জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের সামরিক শাখার বিশ্ব মিত্র চাকমা ওরফে যুদ্ধ বাবু এক কোম্পানি কমান্ডার নিজ দলীয় সহকর্মীর গুলিতে নির্মম ভাবে নিহত হয়েছেন। বিশ্ব মিত্রকে হত্যা হত্যার পর একটি এসএমজি (সাব মেশিনগান), একটি একে-৪৭ রাইফেল, একটি বিদেশি পিস্তল ও ২৫৭ রাউন্ড গুলি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে যায় করে সহকর্মী সুজন।

১৪ জুন রাঙ্গামাটির আরেক উপজেলা জুরাছড়িতে পাথর মণি চাকমা নামে এক গ্রাম প্রধানকে প্রকাশ্য গুলিতে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। উপজেলা সদর হতে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে জুরাছড়ি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের লুলাংছড়ি নামক পাহাড়ি গ্রামে ওই ঘটনাটি ঘটে। পাথর মণি চাকমা ওই গ্রামের কারবারি ছিলেন।

১৭ সেপ্টেম্বর জেলার বাঘাইছড়িতে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সদস্য সুরেশ কান্তি চাকমা ওরফে দীনেশকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষীয় দলের সন্ত্রাসীরা। বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গল তলী ইউনিয়নের বি ব্লক এলাকায় ঘটনাটি ঘটে।

১৬ অক্টোবর রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে ঘরে ঢুকে হত্যা করা হয়েছে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থী নেওথোয়াই মারমাকে। কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা থানার চিৎমরম ইউনিয়নের আগারপাড়া এলাকায় ওই ঘটনাটি ঘটে। নেওথোয়াই মারমা ছিলেন দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনে চিৎমরম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি।

২৭ অক্টোবর একই উপজেলায় কাপ্তাইয়ে নির্বাচনি সহিংসতায় সজিবুর রহমান নামে এক ইউপি (ইউনিয়ন পরিষদ) সদস্য প্রতিপক্ষীয় দলের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কাপ্তাই নতুন বাজার এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। সজিব ছিলেন কাপ্তাই ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এবং কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল লতিফের সমর্থক।

৩০ নভেম্বর রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার ৫ নম্বর বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের চারিখং এলাকার কিচিং আদাম নামক গ্রামে প্রতিপক্ষীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে আবিস্কার চাকমা নামে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) এক সদস্য নিহত হয়েছেন।

সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দাবি, পার্বত্য চুক্তি বাস্তায়িত না হওয়ার কারণে পাহাড়ে এ ধরনের সহিংস ঘটনাগুলো ঘটছে। প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শাসক গোষ্ঠীর লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের হামলায় ঘটনাগুলো ঘটছে।

এক বক্তব্যে শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, অনাকাংখিত কোনো মৃত্যুই কাম্য হতে পারে না। পাহাড়ের মানুষ শান্তি চায়। এসব সহিংসতা বন্ধে সবাইকে সহনশীল হয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসুত্রিতা, দলগুলোর মধ্যে বিভাজন- এখানকার পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সংঘাত বাড়ছে। রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে আরও চিন্তাভাবনা করতে হবে।

পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকার ও প্রশাসনের কাছে দাবী জানিয়েছেন পাহাড়ের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।

রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার মীর মোদ্দাছ্ছের হোসেন বলেন, ২৯ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে গোলাগুলিতে ২ জন নিহতের ঘটনাটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটির চলমান ইউপি নির্বাচনের সঙ্গে কোনো রকম সম্পৃক্ততা নেই। মূলত পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারের জন্য এসব ঘটনা ঘটছে। বাঘাইছড়ির হত্যাকান্ডে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। সন্ত্রাসী যেই হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রতিরোধের ব্যাপারে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগামীতে আরও কঠিন হবে।

Related Articles

Back to top button